1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ইউরোপের আন্দোলন: কয়েকটি মুহূর্ত

শবনম সুরিতা, ডয়চে ভেলে
শবনম সুরিতা
৪ আগস্ট ২০২৩

রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ব্যক্ত কীভাবে, কেন ও কখন করতে হবে, তা নিয়ে সমাজতাত্ত্বিকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে৷ কিন্তু সমকালীন রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে এবিষয়ে বেশ কয়েকটি নজির সৃষ্টি হয়েছে ইউরোপের বিভিন্ন কোণে৷

https://p.dw.com/p/4UlRw
আন্দোলনের উত্তরাধিকার প্রকাশ করাটাও ইউরোপের রাজনীতির একটি লক্ষণীয় দিক
আন্দোলনের উত্তরাধিকার প্রকাশ করাটাও ইউরোপের রাজনীতির একটি লক্ষণীয় দিকছবি: Erbil Basay/AA/picture alliance

সেই নবযুগের শুরু, রেনেসাঁ থেকে ধর্ম আর রাষ্ট্র আলাদা করার দাবির রিফর্মেশন আন্দোলন, বা ফরাসি বিপ্লব৷ বা ষাটের দশকের একঝাঁক নাগরিক আন্দোলন থেকে সাম্প্রতিক কালের করোনা বিধিবিরোধী আন্দোলন- চিরকালই ইউরোপের মানুষ বিশ্বকে শিখিয়েছে‘আন্দোলন শিল্পের' নানা সম্ভাবনার কথা৷

আন্দোলন শিল্প কেন? বরং প্রশ্ন করি, কেন শিল্প নয়? রাষ্ট্রের মতো কাঠখোট্টা একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানাতে এক দল মানুষ যখন নির্দ্বিধায় হাতে তুলে নেন গিটার, কলম, মুহূর্তে লিখে ফেলেন কালজয়ী স্লোগান, তখন গণতন্ত্রের হাতিয়ার শিল্পের খুব কাছাকাছি চলে যায় না কি?

যেমন খুব পরিচিত স্লোগান 'নো পাসারান', স্প্যানিশ ভাষায় যার অর্থ 'তাদের যাবার পথ নেই'৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন ফ্রান্স থেকে এই স্লোগান যায় ১৯৩৬ সালের স্পেনে৷ সেখানে তখন চলছে গৃহযুদ্ধ৷ বামপন্থি নেত্রী দোলোরেস গোমেজের মুখে তখন জাতীয়তাবাদীদের বিরুদ্ধের স্লোগানই হাতিয়ার, 'নো পাসারান'৷ মাদ্রিদ দখলের পর যখন বামপন্থিরা পরাজিত, জাতীয়তাবাদী নেতা ফ্রাংকোর উত্তর গোমেজকে, ‘‘হেমোস পাসাদো', অর্থাৎ 'আমরা চলে এসেছি৷''

সেই ‘নো পাসারান' তারপর বহু দশক ঘুরে নিকারাগুয়া, যুক্তরাজ্য ঘুরে এসে পৌঁছেছে চলতি দশকের কলকাতাতেও৷ সেখানেই ছাত্র আন্দোলন করতে গিয়ে আমার এই স্লোগান বলতে শেখা৷ বহু দিন জানতাম না, এই স্লোগানেরও, আন্দোলন শিল্পের আরো নানা পণ্যের মতোই, আঁতুরঘর ইউরোপই৷

 কিন্তু ইউরোপের সব দেশে আন্দোলনের বহিঃপ্রকাশ এক রকম নয়৷ বিংশ শতাব্দীর নারীবাদী আন্দোলনগুলি এর উদাহরণ৷ কমিউনিস্ট আদলের সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলিতে বিংশ শতাব্দীর একেবারে গোড়া থেকেই গর্ভপাত বৈধ ছিল৷ অন্যদিকে, জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, স্পেন, বেলজিয়ামের মতো পশ্চিমা রাষ্ট্রে তা এসে পৌঁছায় অনেক দেরিতে৷ তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিতে বৈধ হয় ১৯৭২ সালে, বেলজিয়ামে ১৯৯০ সালে ও সুইজারল্যান্ডে ২০০২ সালে৷

এই দাবির এত দূর আসার পেছনে ছিল সেই সময়ের নারীবাদী রাজনৈতিক আন্দোলন৷ জার্মানিতে গর্ভপাতের অধিকারের আন্দোলন অনেকাংশেই চলতো দুই ধাপে - রাজপথে ও মগজে৷ মগজের আন্দোলন কেমন? তাকে সেভাবে দেখা যায় না, কিন্তু তার খপ্পরে পড়ার পর বোঝা যায় যে, সে এসেছে৷

১৯৭১ সালের জুন৷ গর্ভপাত করালেও তা চেপে রাখার, লুকোবার দিন তখন৷ বর্তমান জার্মানি থেকে খুব একটা আলাদা ছিল না সমাজ৷ সেই সময়, নামকরা পত্রিকা ষ্টেয়ার্নের কভারে ৩৭৪ জন নারী৷ সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে আসা, বিভিন্ন বয়েসের ৩৭৪ নারী৷ তারা বুক ঠুকে বলছেন, ‘‘হ্যাঁ, আমরা গর্ভপাত করিয়েছি৷''

সেই ছবিতেই শুরু৷ মগজে আন্দোলন শুরু হবার সাথে সাথে রাজপথেও সেই আন্দোলন চলকে পড়ে৷ বদলায় আইন৷ এমনই ক্ষমতা মগজের আন্দোলনের৷

বর্তমান জার্মানিতে রাষ্ট্র যখনই নারীর শরীরে খবরদারি করতে চায়, বিরোধীদের হাতে অনেক সময়েই দেখা যায় ষ্টেয়ার্ন পত্রিকার সেই ছবি৷ আন্দোলনের উত্তরাধিকার প্রকাশ করাটাও ইউরোপের রাজনীতির একটি লক্ষণীয় দিক৷

আজকের ইউরোপে আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য কী? তার শিল্প কোথায়?

এই প্রশ্নে অনেকেই বিচলিত৷ বর্তমান ইউরোপের পরিবেশবাদী আন্দোলন নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বেশি পরিচিত৷ গ্রেটা থুনবের্গ, লুইজা নয়বাওয়ারের নাম জানে বিশ্বের তরুণ প্রজন্ম৷ কিন্তু এরা ছাড়াও ইউরোপে জলবায়ু নিয়ে ভাবিত তরুণ রয়েছে, যাদের মধ্যে অন্যতম 'লাস্ট জেনারেশন'৷

তারা নিত্য নতুন পন্থা আবিষ্কার করছে সমালোচনা ব্যক্ত করার, তা ঠিক৷ কিন্তু তাদের আন্দোলনের মাধ্যম যে সমালোচিত হচ্ছে না, তা নয়৷  পুলিশের বিরুদ্ধে অসহযোগ দেখাতে গিয়ে নিজেদের আঠা দিয়ে রাস্তায় আটকে দেয় তারা৷ কখনো কখনো দামি কোনো ছবির গায়ে খাবার ঢেলে বোঝাতে চায় যে পরিবেশের চেয়ে কোনো শিল্প মূল্যবান নয়৷

সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হলেও এমন জনতোষ পন্থা খুব বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে না৷ উল্টো, রাষ্ট্র নানা রকমের আইনি মারপ্যাঁচে ফেলছে বিক্ষোভকারীদের৷

এখানে প্রশ্ন ওঠে, বাজার ও রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে৷

বর্তমান সময়ের কোনো আন্দোলন কোন পথে প্রবাহিত হবে, তা ঠিক করায় বড় ভূমিকা রাখে বাজার ও রাষ্ট্র৷ ফলে, যে কোনো আন্দোলনকেই আজকের সময়ে নিজের ‘আবেগকে' নিয়ন্ত্রণ করতে জানতে হবে৷

শবনম সুরিতা, সাংবাদিক, ডয়চে ভেলে
শবনম সুরিতা, সাংবাদিক, ডয়চে ভেলেছবি: Philipp Böll/DW

কিন্তু কৌশল ভুললে চলবে না৷ তাকে শিখতে হবে বাজারের কায়দা-কানুন৷ বুঝতে হবে কোন কনটেন্ট মিম, আর কোন কনটেন্ট মানুষকে ভাবায়৷

সাথে চিনতে হবে আজকের এআই, ইন্টারনেটের নজরদারিসহ রাষ্ট্রের সদ্য পাওয়া অস্ত্রদের৷ ইউরোপে ব্যক্তিস্বাধীনতা, গোপনীয়তার অধিকার ও বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হাজারো আইন রয়েছে৷ ফলে, প্রতিবাদ বা অসন্তোষ ব্যক্ত করার জায়গা ও মানসিকতা দুটিই এখানে রয়েছে৷

২০১৭ সালের জি২০ বৈঠকের সময় দেখেছিলাম কীভাবে নিঃশব্দে ট্রাম্পপন্থি ও ট্রাম্পবিরোধীরা রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে যে যার কর্মসূচি চালিয়ে গেলেন, কোনো বাকবিতণ্ডা ছাড়াই৷ যেটা অনেক সময় আমার নিজের দেশ ভারতে বা খোদ ট্রাম্পের দেশ যুক্তরাষ্ট্রেও সম্ভব হয় না৷

তাই এখানে মাঝেমাঝে দেখা যায় এক আজব আন্দোলনের দৃশ্য৷ রাস্তা বন্ধ করে মাটিতে বসে আছেন জনা ১৫ বা ১৬ প্রতিবাদী৷ তাদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য (যদিও কোনো প্রতিবাদীই সহিংস আচরণ করছে না) উল্টোদিকে মোতায়েন প্রায় জনা ৩০ পুলিশ সদস্য৷ এবং বন্ধ রাস্তায় আটকে পড়া বাস, গাড়িতেও চুপচাপ বসে আছে সবাই৷ কারো কোনো আক্ষেপ নেই, ভ্রুক্ষেপ নেই৷

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম থেকে আসা আমি এদের দেখি, আর অবাক হই, এটাও অসহযোগ? এটাও আন্দোলন?