1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

রোহিঙ্গাদের নিয়ে উভয় সংকটে বাংলাদেশ

সমীর কুমার দে ঢাকা
৯ জুন ২০২৩

জাতিসংঘ সহায়তা কমিয়ে দিচ্ছে, অভ্যন্তরীণ বাজেট থেকে ভর্তুকি দেয়ারও অবস্থা নেই, ঠিক এমন পরিস্থিতিতে পাইলট প্রকল্পের আওতায় এক হাজারের কিছু বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়ায় বাধ সাধছে জাতিসংঘ৷

https://p.dw.com/p/4SOOq
উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের সমাবেশের ছবি৷
উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের সমাবেশের ছবি৷ছবি: Mohibulla Mohib

অন্যদিকে দেশে ফেরানোর দাবিতে রোহিঙ্গাদের একাংশও এখন সোচ্চার৷

দ্রুত প্রত্যাবাসনসহ চার দফা দাবি জানিয়ে কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে বৃহস্পতিবার সমাবেশ করেছেন রোহিঙ্গারা৷ ‘দ্রুত প্রত্যাবাসন’ ক্যাম্পেইন শেষে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়৷ সমাবেশে রোহিঙ্গারা ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড ও শ্লোগানে নিজ দেশ মিয়ানমারে নিজেদের বাড়িঘরে ফিরে যাওয়া, নাগরিকত্বের স্বীকৃতি, নিরাপত্তা এবং অন্য জাতিগোষ্ঠীর লোকজন যেভাবে অবাধে চলাফেরা করে তেমন স্বাধীনতাসহ চার দাবি তুলে ধরে মোনাজাতে দোয়া চান৷

দেশে ফেরানোর দাবিতে রোহিঙ্গাদের সমাবেশ

সমাবেশে নেতৃত্ব দেওয়া মাঝিদের একজন টেকনাফের ২৬ নম্বর ক্যাম্পের বদরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা তো নিজ দেশে ফিরে যেতে চাই৷ সেক্ষেত্রে আমাদের চার দফা দাবি রয়েছে৷ প্রথমত, আমাদের নাগরিকত্ব দিতে হবে৷ দ্বিতীয়ত, নিজেদের বাড়ি ঘর ফিরিয়ে দিতে হবে৷ তৃতীয়ত, অন্য জাতিগোষ্ঠীর মতো আমাদেরও স্বাধীনভাবে চলাচলের স্বাধীনতা দিতে হবে৷ চতুর্থত, আমাদের নিরাপত্তা দিতে হবে৷ এই জিনিসগুলো ঠিক হলেই আমরা সেখানে চলে যাবো৷ আমরা আর ক্যাম্প জীবন চাই না৷ আগে যেখানে জাতিসংঘ ১২ ডলার দিত, এখন সেখানে ৮ ডলার দিচ্ছে৷ এই টাকা দিয়ে কী হয়? আমরা অনেক কষ্টে চলছি৷ এই বন্দি জীবন থেকে মুক্তি চাই৷’’ 

এই বন্দি জীবন থেকে মুক্তি চাই: বদরুল ইসলাম

আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান রোহিঙ্গা নেতা ডা. মোহাম্মদ জোবায়ের ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আজ হোক আর কাল হোক আমাদের তো যেতেই হবে৷ আমরা তো বাংলাদেশে সারাজীবন থাকতে পারবো না৷ ফলে আমরা আর শরণার্থী জীবন চাই না৷ সামনের দিনগুলোতে আমরাও আমাদের জন্মভূমি আরাকানে জীবনযাপন করতে চাই৷ বিশ্ব সম্প্রদায় আমাদের দেশে ফেরার ব্যাপারে যেন কার্যকর কোনো ব্যবস্থা দেয়৷’’

রোহিঙ্গাদের সমাবেশের ব্যাপারে জানতে চাইলে অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (উপ-সচিব) খালিদ হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গারা দ্রুত প্রত্যাবাসন দাবি শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করেছে৷ সেখানে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া দাবি জানিয়ে রোহিঙ্গারা কয়েকটি দাবি তুলেছেন৷’’ বলা হচ্ছে, যারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে আগ্রহ দেখিয়েছে, তাদের রেশন বন্ধ করে দিয়েছে ইউএনএইচসিআর? এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘চারটি পরিচারের ক্ষেত্রে এমন হয়েছিল, সেটা ঠিক হয়ে গেছে৷ আমরা চেষ্টা করছি, যত দ্রুত প্রত্যাবাস প্রক্রিয়া শুরু করা যায়৷’’

জোর  করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে জাতিসংঘের আপত্তি

বাংলাদেশকে পাইলট প্রকল্পের আওতায় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ বন্ধের আহবান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মিয়ানমারের পরিস্থিতি বিষয়ক বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ের টম অ্যান্ড্রুস৷ তিনি বলেছেন, মিয়ানমারের রাখাইনে এখনো রোহিঙ্গাদের জীবন ও চলাচলের স্বাধীনতা ঝুঁকিতে রয়েছে৷ বৃহস্পতিবার জেনেভা থেকে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে৷ সেখানে টম অ্যান্ড্রুস বলেছেন, বাংলাদেশ ‘বিভ্রান্তিমূলক’ এবং ‘বলপ্রয়োগের’ মতো পদক্ষেপের মাধ্যমে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফিরে যেতে বাধ্য করছে৷

উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের সমাবেশের ছবি৷
উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের সমাবেশের ছবি৷ছবি: Mohibulla Mohib

টম অ্যান্ড্রুস বলেন, মিয়ানমারের পরিস্থিতি রোহিঙ্গাদের নিরাপদে, মর্যাদার সঙ্গে স্থায়ীভাবে ও স্বেচ্ছামূলক প্রত্যাবাসনের জন্য সহায়ক নয়৷ সিনিয়র জেনারেল মিন হং হ্লায়েং রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছিলেন৷ তিনি এখন নিষ্ঠুর এক সামরিক শাসনযন্ত্রের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যারা বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা চালাচ্ছেন এবং রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও অন্যান্য মৌলিক অধিকারকে প্রত্যাখ্যান করে চলেছেন৷ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কর্মকর্তারা সুনির্দিষ্টভাবে কোনো তারিখ উল্লেখ না করলেও প্রাথমিকভাবে ১ হাজার ১৪০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে পাঠানোর কথা উল্লেখ করেছেন৷ চলতি বছরের শেষ নাগাদ আরো ছয় হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর কথা৷ বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, প্রথম দফায় লোকজনকে পাঠানোর বিষয়টি শিগগির ঘটতে পারে৷ যারা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করছে, তাদের সরকার গ্রেপ্তারের হুমকি, কাগজপত্র জব্দ ও নানা ধরনের প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে৷ পাইলট প্রকল্পের আওতায় রোহিঙ্গাদের নিজেদের গ্রামে ফিরতে দেওয়া হবে না৷ ২০১৭ সালের গণহত্যা পরিচালনার সময় যে হামলা চালানো হয়েছিল, তখনো অনেক গ্রাম গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে৷ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মংডুর অভ্যর্থনা ও অন্তর্র্বতীকালীন শিবিরে রাখা হবে৷ এরপর তাদের নতুন করে তৈরি ১৫টি গ্রামে নেওয়া হবে৷ রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরে যাওয়ার পর অবাধে চলাফেরা করতে দেওয়া হবে না৷ 

জাতিসংঘের মিয়ানমারের পরিস্থিতি বিষয়ক বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ার বলেন, ‘‘এই পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গারা ফিরে গেলে আন্তর্জাতিক আইনে বাংলাদেশের বাধ্যবাধকতার লঙ্ঘন হবে৷ কারণ, রাখাইনে ফিরে গেলে রোহিঙ্গারা ব্যাপকতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের পাশাপাশি ভবিষ্যতে নৃশংস অপরাধের শিকারে পরিণত হতে পারে৷ তাই বাংলাদেশকে আমি অনতিবিলম্বে এই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পাইলট প্রকল্প স্থগিত করার অনুরোধ করছি৷’’

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘জাতিসংঘের আহবানের আগেই পাইলট প্রকল্প স্থগিত হয়ে গেছে৷ যেটার ঘোষণা এখনও আসেনি৷ পাইলট প্রকল্পে যে ১ হাজার ১৪০ জনের নাম আছে, তাদের অনেকেই এখন যেতে চান না৷ ফলে যারা যেতে চায় তাদের একটা তালিকা তৈরি করা হচ্ছে৷ সেই তালিকা নিয়ে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমরা আলোচনা করবো৷ তারা রাজি হলে প্রত্যাবাসন শুরু হতে পারে৷’’

আমরা দেখছি, চাপটা বারবারই বাংলাদেশের উপরই আসছে: অধ্যাপক ড. আমেনা মহসিন

তবে বাংলাদেশের শক্ত অবস্থানের পক্ষে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. আমেনা মহসিন৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের অবস্থাটা আমাদের বুঝতে হবে৷ আমার মনে হয় না, পাইলট প্রকল্প বন্ধ করা উচিত৷ জাতিসংঘ যে অভিযোগগুলো তুলেছে, সেগুলোর তদন্ত করা হোক৷ বাংলাদেশ সরকার কিন্তু কাউকে জোর করে পাঠাবে না, সেটা বলেছে৷ আমরা এটাও দেখছি, ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম কিন্তু কাট ডাউন করছে৷ এটা কিন্তু স্ববিরোধিতা৷ মিয়ানমার তো গণহত্যা সংগঠিত করেছে৷ সেখানে আমি এমন কিছু দেখছি না, জাতিসংঘ তাদের উপর কোনো স্যাংশন দিচ্ছে৷ উল্টো আমরা দেখছি, মিয়ানমারের সঙ্গে বিভিন্ন রাষ্ট্র ব্যবসা-বাণিজ্য করছে৷ সেখানে বিনিয়োগ করছে৷ তারা তো পার পেয়েই যাচ্ছে৷ আমরা দেখছি, চাপটা বারবারই বাংলাদেশের উপরই আসছে৷ ফলে পাইলট প্রকল্প বন্ধ না করে অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চালু করা উচিত৷’’

দাতা দেশগুলো মানবিক সহায়তা যতটুকু প্রয়োজন সেটা দিচ্ছে না: আসিফ মুনীর

তবে শরণার্থী বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর মনে করেন, পাইলট প্রকল্প নিয়ে অনেক ধরনের বিভ্রান্তি রয়েছে৷ এই প্রকল্প বন্ধ হলে বাংলাদেশ আরো বেশি চাপে পড়বে কিনা জানতে চাইলে জনাব মুনীর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রথমত, সরকারের দিক থেকে এটা পরিস্কার করা দরকার৷ এটার সঙ্গে জাতিসংঘকে কিন্তু সম্পৃক্ত করা হয়নি৷ ফলে তার বিষয়টি জানতো না৷ গত মার্চে যারা ঘুরে এসেছেন, তারা কিন্তু বলছেন, তারা সন্তুষ্ট না৷ আমরা তো চাই স্থায়ী সমাধান৷ এই পরিস্থিতিতে যে কারো সন্দেহ হতেই পারে যে, তাদের স্বেচ্ছায় পাঠানো হচ্ছে কিনা৷ এটা কিন্তু মানবাধিকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ এখন বাংলাদেশের উপর যে চাপ বাড়ছে সেটার ভিন্ন অবস্থা রয়েছে৷ জাতিসংঘের আলাদা আলাদা দপ্তর রয়েছে৷ যে দপ্তর থেকে জোর করে না পাঠাতে বলছে তারা এবং ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম কিন্তু জাতিসংঘের আলাদা সংস্থা৷ তাদের কিন্তু স্বতন্ত্র সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গা রয়েছে৷ বিভিন্ন সংস্থা যে তাদের অর্থায়ন কমাচ্ছে তার বড় জায়গা হলো, দাতা দেশগুলো মানবিক সহায়তা যতটুকু প্রয়োজন সেটা দিচ্ছে না৷ এখানে জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান যেটা হয় সেটা কিন্তু আন্তর্জাতিক সংস্থার পরিকল্পনা না৷ এখানে সরকারও আছে, আন্তর্জাতিক সংস্থাও আছে, জাতিসংঘও আছে৷ এখানে মূলত চাপটা বাড়ানো দরকার৷’’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) চেয়ারপার্সন ড. তাসনীম সিদ্দিকী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘রোহিঙ্গারা তো নিজ দেশে ফেরত যেতে চান৷ আমাদের সরকারও তো বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছে৷ কোনোভাবেই মিয়ানমার রাজি হচ্ছে না৷ এখানে হয়ত বাংলাদেশ তাদের উপর চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করছে৷ এটা ঠিক যে, ওখানে এখনও পরিস্থিতি স্বাভবিক না৷ আবার এটাও ঠিক, এদের ফেরত পাঠাতে কেউ কিন্তু ওভাবে সাপোর্ট দিচ্ছে না৷ এমনকি জাতিসংঘও না৷ সুতরাং এদেরকে চাপে রাখতে বাংলাদেশের কিছু শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন রয়েছে৷ অনেকেই আস্তে আস্তে হাত গুটিয়ে নিচ্ছে৷ এরা তো বাংলাদেশে নানা রকমের সমস্যার সৃষ্টি করছে৷ ফলে কখনো কখনো শক্ত অবস্থান নেওয়ার দরকার আছে৷ কিন্তু এর মানে এই নয় যে, এখনই তাদের জোর করে ধরে সেখানে পাঠিয়ে দেবে৷’’

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইন অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্বিচারে হত্যা ও নির্যাতন শুরু করে৷ তখন সীমান্ত অতিক্রম করে প্রায় ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারে এসে আশ্রয় নেয়৷ আগে থেকেই এখানে ছিল আরো কয়েক লাখ নিপীড়িত রোহিঙ্গা৷ ফলে সব মিলিয়ে এখানে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা বর্তমানে ১২ লাখের বেশি৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য