1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

নিম্ন আয়ের মানুষের দুর্দিন, ঋণ করে চলছে ৭৪ ভাগ পরিবার

৩০ মার্চ ২০২৩

বাংলাদেশের চার কোটি নিম্ন আয়ের মানুষের দুর্দিন চলছে৷ এই নিম্ন আয়ের শতকরা ৭৪ ভাগ মানুষই ঋণ করে চলছেন৷ সহসাই এই পরিস্থিতির উন্নতিও হবে বলেন মনে করছেন না তারা৷

https://p.dw.com/p/4PVoP
ফাইল ফটো
ফাইল ফটোছবি: Mortuza Rashed/DW

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে৷
সানেমের নির্বাহী পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান মনে করেন, "তারা ঋণের এই ফাঁদ থেকে বের হতে পারবেন বলে মনে হয় না৷ কারণ তারা বিভিন্ন এনজিও এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়েছেন৷ বিপরীতে তাদের আয়ও বাড়ছে না৷”
আর ইউএনডিপির কান্ট্রি ইকোনমিস্ট ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, "এই নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে যারা ফিক্সড ইনকামের তাদের অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ৷ যা সঞ্চয় ছিল তাও শেষ৷ এখন তারা ঋণে জর্জরিত হচ্ছেন৷”
ঋণে চলছে সংসার:
দেশের আট বিভাগের এক হাজার ৬০০ পরিবারের ওপর মার্চ  মাসে জরিপ করে সানেম৷ তবে অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি-এই ছয় মাসের তথ্য নেয়া হয়েছে৷
সানেম বলছে যে ৭৪ শতাংশ পরিবার ঋণ করে চলেছে, তাদের ঋণ করা বন্ধ হয়েছে বা বন্ধ হবে, এমন পরিস্থিতি এখনো আসেনি৷ আর পরিস্থিতি যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে ৮৫ শতাংশ পরিবারের কথা হলো আগামী ছয় মাসে তাদের আরো ঋণ করতে হবে৷
সঞ্চয় বিমুখ হয়েছে ৫৫ শতাংশ পরিবার৷ ৮৫ শতাংশ পরিবার মনে করে যে আগামী ছয় মাসে তাদের আরো ঋণ করে চলতে হবে৷ ৩৫ শতাংশ পরিবার তাদের সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে৷
ওই ছয় মাসে ঋণের উৎস হিসেবে ৪৫ শতাংশ পরিবার বেছে নিয়েছে ক্ষুদ্র ঋণের প্রতিষ্ঠান৷ ৩৭ শতাংশ পরিবার আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে৷ সমবায় সমিতি থেকে ধার করছে ২৩ শতাংশ পরিবার৷ এ ছাড়া ব্যাংক ও মহাজনি ঋণ নিয়েছে যথাক্রমে ১৪ ও তিন শতাংশ পরিবার৷ ঋণ করার জন্য আরো অনেক পথ খুঁজছে মানুষ৷ ৪১ শতাংশ পরিবার বলেছে, ভবিষ্যতে তাদের ভিক্ষা বা শর্তহীন সাহায্য নিয়ে চলতে হতে পারে৷ টিকে থাকার জন্য শহর থেকে গ্রামে যেতে চায় বেশির ভাগ মানুষ৷
৯০ ভাগ পরিবার খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছে:
আয় না বাড়লেও গত ছয় মাসে এসব পরিবারের ব্যয় বেড়েছে ১৩. ১ শতাংশ৷ ফলে ঋণ করেও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছেনা তারা৷ তাদের খাদ্য তালিকা কাটছাঁট করতে হচ্ছে৷ তাই তাদের ৯৬ শতাংশ পরিবার মাংস খাওয়া কমিয়েছে৷ গ্রাম ও শহরের নিম্ন আয়ের পরিবারের যারা এই জরিপে অংশ নিয়েছে, তাদের ৯০ শতাংশ পরিবার অর্থনৈতিক চাপে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে৷
ছয় মাস আগেও যেসব পরিবারে মাসে চার বার মুরগি খেত, এখন তারা দুই বার মুরগি খায়৷ মাছ খাওয়া কমিয়েছে ৮৮ শতাংশ পরিবার৷ এ ছাড়া ৭৭ শতাংশ পরিবার ডিম ও ৮১ শতাংশ পরিবার ভোজ্যতেল খাওয়া কমিয়েছে৷
৩৭ শতাংশ পরিবার বলেছে, তাদের এখন মাঝে মধ্যে কোনো এক বেলা খাবার না খেয়ে থাকতে হচ্ছে৷ প্রয়োজনের তুলনায় খাবার কম খাচ্ছে বলে মনে করে ৭১ শতাংশ পরিবার৷ ১৮ শতাংশ পরিবারের লোকজন বলেছেন ছয় মাসে এমন কিছুদিনও গেছে, যেদিন তাদের পুরো দিন না খেয়ে থাকতে হয়েছে৷ জরিপে অংশ নেয়া পরিবারের মধ্যে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আছে মাত্র ৪০ শতাংশ নিম্ন আয়ের পরিবার৷ এর মধ্যে বেশির ভাগ আছে টিসিবির পরিবার কার্ডধারী৷
খাদ্যবহির্ভূত পণ্য এবং সেবায়ও নিম্ন আয়ের মানুষ ব্যাপকভাবে খরচ কমিয়েছে৷ বিশেষ করে পোশাক, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য৷ জরিপের তথ্য বলছে, শহরের নিম্ন আয়ের পরিবার খাদ্য কিনতে বেশি কাটছাঁট করছে৷ গ্রামের পরিবারগুলো খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে খরচ কমিয়েছে বেশি৷ সানেম এই পরিস্থিতির জন্য বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, দেশে মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও বাজার অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছে৷
ঋণের ফাঁদে আটকা পড়ছে মানুষ:
ড. সেলিম রায়হান বলেন, "তারা ঋণের ফাঁদে পড়ে যাচ্ছেন৷ কারণ তারা বিভিন্ন এনজিও এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়েছেন৷ তাদের আয়ও বাড়ছে না৷ ফলে তারা এই ঋণ কীভাবে শোধ করবেন সেটাই বড় প্রশ্ন৷”
তিনি বলেন, "গত এক বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে৷ এরজন্য বৈশ্বিক কারণ আছে তবে বাজার ব্যবস্থাপনার সংকট একটি বড় কারণ৷ অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের বাজারে বৃহৎ কর্পোরেট খাতের প্রভাব৷ দেশীয় যেমন আছে আমদানি পণ্যেও আছে৷ এই ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা নেই৷ তারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করে৷ যার নেতিবাচক প্রভাব বাজারে পড়ছে৷”
তিনি জানান,"সম্প্রতি শ্রম জরিপে দেখা গেছে কৃষিতে শ্রমিক বৃদ্ধি পেয়েছে৷ এটা ভালো লক্ষণ নয়৷ কারণ কৃষিতে এমনিতেই উদ্বৃত্ত শ্রমিক আছে৷ এখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত৷ আর শিল্প ও সেবা খাতে কর্মসংস্থান কমেছে৷ কিন্তু এই দুই খাতে কর্মসংস্থান বাড়লে তা হতো ইতিবাচক৷ আমরা কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে উল্টা ট্রেন্ড দেখছি৷ ফলে নিম্ন আয়ের মানুষের আয় বাড়ছে না৷ আমাদের সার্ভে বলছে গত ছয় মাসে তাদের আয় বাড়েনি; কিন্তু ব্যয় বেড়েছে অনেক৷”
সুরক্ষা কীভাবে?
ড. সেলিম রায়হানের মতে, ‘‘নিম্ন আয়ের মানুষকে সুরক্ষা দিতে বাজার মনিটরিং যেমন বাড়াতে হবে তেমনি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিও বাড়াতে হবে৷ আমাদের জরিপে এসেছে এই নিম্ন আয়ের মানুষের শতকরা ২৮ ভাগ টিসিবির ওএমএস কর্মসূচির সুবিধা পান৷ আর শতকরা ৪০ ভাগ ওএমএসসহ আরো যে কর্মসূচি আছে সরকারের তার সহায়তা পান৷ ৬০ ভাগ নিম্ন আয়ের মানুষ কোনো ধরনের সহায়তা পান না৷”
ইএনডিপির কান্ট্রি ইকোনমিস্ট ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, "জরিপের বাইরে গিয়ে বাস্তবেও আমরা দেখি যে আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ কিছু পণ্যের দাম কমে এলেও আমাদের এখানে কমছে না৷ তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমেছে, আমাদের এখানে কি সেভাবে কমেছে?  আগে যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ত এখন সেভাবে না বাড়লেও বাড়ছে৷ এটা বাজার মটিরিংয়ের অভাবে হচ্ছে৷ ব্যবসায়ীরা কোনো জিনিসের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়লে এখানে দ্রুত বাড়িয়ে দেয়; কিন্তু কমলে কমায় না৷ নানা অজুহাত দেখায়৷”
তার কথা, "যারা নিম্ন আয়ের ফিক্সড ইনকামের মানুষ তাদের দিকে এখন নজর দেয়া জরুরি৷ কারণ তারা সঞ্চয় ভেঙে খেয়ে ফেলেছেন৷ এখন ঋণ করছেন৷ ”
তিনি বলেন, "দেশে কোটিপতি বেড়েছে, মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে৷ তাই তাদের দায়িত্বের মধ্যে আনতে হবে৷ সরকারের যে খাদ্য কর্মসূচিগুলো রয়েছে সেগুলো বাড়ানোর পাশাপাশি ধনী লোকদের কাছ থেকে সরকার অর্থ সংগ্রহের কৌশল নিতে পারে৷ তাদের যে ট্যাক্স দেয়ার কথা তা তো সবাই দেয়না তাই তাদের কাছ থেকে জাকাত নিয়ে তা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষকে দেয়া যেতে পারে৷ নানা অ্যাপ ব্যবহার করে অর্থ সংগ্রহ করা যায়৷” আর আগামী বাজেটে অবশ্যই সামাজিক নিরপত্তা খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়াতে হবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ৷

‘আন্তর্জাতিক বাজারে কিছু পণ্যের দাম কমে এলেও এখানে কমছে না’

‘বাজার মনিটরিং ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাড়াতে হবে’