1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

নদী চুরি আর কী এমন আশ্চর্য ঘটনা!

২ জুন ২০২৩

একদিকে দূষণ, অন্যদিকে নদীখাতের বালি চুরি, একদিকে নগরায়ন অন্যদিকে নদীখাতে পাট্টা বিতরণ-- ভারতে নদী যে এখনো বেঁচে আছে, সেই এক আশ্চর্য৷

https://p.dw.com/p/4S6B9
কলকাতার গড়িয়া বাজারের কাছে আদিগঙ্গা নদী৷
কলকাতার গড়িয়া বাজারের কাছে আদিগঙ্গা নদী৷ তবে স্থানীয়দের অনেকেরই জানা নেই যে এটি একটি নদী৷ তাদের কাছে এটি আবর্জনা ফেলার জায়গা মাত্র৷ছবি: Subrata Goswami/DW

কথায় বলে, যদির কথা নদীতে যাক৷ ঘোর কলিকালে বলা ভালো, নদীর কথা যদিতে... বহমান কালের স্রোতে একের পর এক নদী যেভাবে সত্যি সত্যি যদি হয়ে গেছে, সে ইতিহাস শুনলে আতঙ্কের হিম স্রোত শিড়দাঁড়া বেয়ে বয়ে যাওয়া উচিত৷ কিন্তু বইছে না৷ আর সে জন্যই কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলি নদীর নামে হাজার হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ ঘোষণা করছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না৷

নদী নিয়ে লিখতে বসলে প্রবন্ধের উৎস এবং মোহনা স্থির করা কঠিন৷ কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখব? ভারতের সর্ববৃহৎ নদী গঙ্গা৷ নমামি গঙ্গে নামে গঙ্গা সংস্কারের বিরাট প্রকল্প ঘোষণা করেছে সরকার৷ লাখ লাখ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে৷ কিন্তু দূষণ নিয়ন্ত্রণ এখনো যে তিমিরে সেই তিমিরেই৷ ফলে গঙ্গার দূষণ নিয়ে সাম্প্রতিক যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে দেখা গেছে, দূষণের মাত্রা কমেনি বরং জায়গায় জায়গায় বেড়েছে৷ এলাকা ধরে ধরে সেই রিপোর্টে দেখানো হয়েছে, নদী দূষণের মাত্রা ঠিক যেমন ছিল, এখনো ঠিক তেমনই৷ নিকাশির জল পরিশোধন করে নদীতে ফেলার প্রবণতা খানিকটা বাড়লেও, তাতে খুব বেশি লাভ হয়নি৷ নিকাশির জল থেকে তৈরি হওয়া দূষণের পরিমাণ এখনো বিপদসীমার অনেক উপরে৷ রিপোর্টের গভীরে যাচ্ছি না৷ গেলে কেবল এই একটি রিপোর্ট নিয়েই কয়েক হাজার শব্দ লিখে ফেলতে হবে৷ বস্তুত, নিম্নগাঙ্গেয় উপত্যকায় গঙ্গার অবস্থা নিয়ে এ লেখার একেবারে মোহনায় আরো একবার আসা যাবে৷ গঙ্গা বড় নদী৷ তাকে নিয়ে আলোচনাও বেশি৷ আজ বরং কিছু ছোট ছোট নদীর মর্মান্তিক মৃত্যুবার্তা নিয়েই আলোচনা করা যাক৷

তবে সে কথায় ঢোকার আগে দিল্লি পার্শ্ববর্তী যমুনার এক চিলতে তথ্য না দিলেই নয়৷ উত্তর ভারতের ধর্মপ্রাণ মানুষ গঙ্গা এবং যমুনা নদীকে কেবল নামে সম্বোধন করেন না৷ নামের শেষে একটি ‘জি’ বসিয়ে বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করেন৷ গঙ্গাজি, যমুনাজি৷ আদি-অকৃত্রিম কাল থেকে ভারতীয় সভ্যতা শুনে আসছে গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী এই তিন নদীর মহতি তাৎপর্য৷ হিমালয়ের যমুনোত্রী থেকে নামার পর সব মিলিয়ে দেড় হাজার কিলোমিটারের কাছাকাছি যাত্রা করে এই ‘যমুনাজি’৷ মোট যাত্রাপথের মাত্র দুই শতাংশ এলাকা দিল্লিকে ছোঁয়৷ আর এই দুই শতাংশ অংশে যমুনার ৬০ শতাংশ দূষণ ঘটে যায়৷ নিকাশি নালা থেকে কারখানার নোংরা-কোনোরকম পরিশোধন ছাড়া সব এসে মেশে ভক্তির যমুনাতে৷ সকলে সব জানেন, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না৷ ফলে যমুনার খাত ছোট হয়ে গেছে৷ কালো, ফেনাওলা জল সাধারণ খালের চেয়েও দূষিত৷ পার্শ্ববর্তী পরিবেশ বিপদের শেষ বিন্দুতে গিয়ে পৌঁছেছে৷

বড় নদী থেকে চলে আসা যাক ছোট নদীর গল্পে৷ কিছুদিন আগে উত্তরবঙ্গের এক সহকর্মী খুব জোর প্রাণে বেঁচেছেন৷ প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে খবরের কাগজে একটি প্রতিবেদন ছেপে ফেলেছিলেন তিনি৷ দেখিয়েছিলেন, উত্তরবঙ্গের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদী সংকোশের নদীখাতটাই কীভাবে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ কারা ঘোরালেন? অবৈধ বালি খাদানের ব্যবসায়ীরা৷ নদীর খাত থেকে বালি তোলার জন্য আস্ত নদীটাই ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ ফলে নদীও তার চরিত্র হারিয়ে মজা খালের চেহারা নিয়েছে৷ এই ছবি তুলতে গিয়েই অবৈধ খাদান মাফিয়াদের হাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ওই সহকর্মী৷ সংকোশের এই ঘটনাকে নদী চুরি বলা যায় না?

নদী চুরির প্রকৃষ্ট উদাহরণ দক্ষিণবঙ্গেও আছে৷ ইছামতী নদীর উপর একের পর এক অবৈধ বালি খাদান তৈরি হয়েছে৷ তৈরি হয়েছে আস্ত আস্ত ইটভাঁটা৷ নদীখাতের বালি এবং মাটি তুলে যারা দিনের পর দিন অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে৷ বলার কেউ নেই৷ ইছামতীর উৎসমুখ মজে গেছে৷ সেখানেও নদীখাতের উপরেই শুরু হয়েছে চাষবাস, তৈরি হয়েছে বাড়ি৷

এ তো গেল অবৈধ নদী চুরি৷ পশ্চিমবঙ্গে বৈধ নদী চুরির ঘটনাও ঘটছে৷ নদিয়া জেলার সদর শহর কৃষ্ণনগর৷ যার পাশ দিয়ে বয়ে যেত অঞ্জনা নদী৷ দীর্ঘদিন ধরে নগরায়নের চাপে এই নদী ক্রমশ মজে গেছে৷ পরিবেশবিদেরা যখন মরা নদীর খাতগুলিকে নতুন করে বাঁচানোর কথা বলছেন, তখন কৃষ্ণনগর পুরসভা রীতিমতো পাট্টা দিয়ে অঞ্জনার খাত বিক্রি করে দিয়েছে৷ সেখানে মানুষ বসবাস করছেন৷ বৈধ নদী চুরি৷

মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জের কাছে খরখরি নদী৷ সেই নদীও স্থানীয় প্রশাসন পাট্টা দিয়ে বিক্রি করে দিয়েছে৷ শিয়ালমাড়ি নদীর খাত এখন আর খুঁজেই পাওয়া যায় না৷ পঞ্চায়েত পাট্টা দিয়ে গোটা নদী খাতই বেচে দিয়েছে৷ ফলে গোটা নদীতে এখন শয়ে শয়ে বাড়ি৷

স্যমন্তক ঘোষ, ডয়চে ভেলে
স্যমন্তক ঘোষ, ডয়চে ভেলেছবি: privat

এমন উদাহরণ আরো আছে৷ অজয়, দামোদর, শিলাবতী নদীগুলি অবৈধ বালিখাদানের আধুনিক সংজ্ঞা তৈরি করে ফেলেছে৷ প্রশাসন, নদী বিশেষজ্ঞ, সরকার-- সবাই সব জানে৷ কিন্তু কেউই শেষপর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেন না৷ কারণ, নদী চুরি তত বড় অপরাধ বলে মনে করেন না তারা৷

এছাড়াও বাঁধ দিয়ে নদীর মূল খাত বন্ধ করে, খাল কেটে সেই জল অন্যদিকে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া সর্বত্র৷ পাহাড়ে তিস্তা থেকে সমতলে গঙ্গা-- সর্বত্র একাজ হয়েছে এবং হয়েই চলেছে৷ একসময় মহারাষ্ট্র-গুজরাত সীমানায় নর্মদা নদী বাঁচাও আন্দোলন করেছিলেন মেধা পাটকর৷ আন্দোলন কিছুটা সফল৷ বাঁধের জন্য যে মানুষদের গ্রাম ভেসে যাচ্ছিল, তারা কিছুটা হলেও ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন আদালতের নির্দেশে৷ কিন্তু বাঁধ আটকানো যায়নি৷

আটকানো যাচ্ছে না সৌন্দর্যায়নের নামে নদীর স্বাভাবিক পাড় বাঁধিয়ে দেওয়ার প্রবণতা৷ কলকাতায় গঙ্গার ধারে সৌন্দর্যায়ন করতে করতে কখন যে নদীখাতে কংক্রিট ফেলে দেওয়া হয়েছে, কেউ খেয়ালও করেননি৷ স্যাটেলাইট ইমেজ পরীক্ষা করে সম্প্রতি নদী বিশেষজ্ঞ সুপ্রতিম কর্মকার দেখিয়েছেন, গঙ্গার ধারে কেবল একটি পার্ক নির্মাণ করতে গিয়ে নদীখাত কতটা সংকীর্ণ করে ফেলা হয়েছে৷

শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে গঙ্গার দীর্ঘপথে কীভাবে দূষণের মাত্রা বেড়ে চলেছে, তা নিয়েও বহু গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে৷ গঙ্গার ধারের শ্মশান এর এক বড় কারণ৷ প্রতিদিন নদীর জলে ফুল এবং খাবার ফেলেও দূষণ ছড়ানো হচ্ছে, পরিবেশবিদেরা সতর্ক করছেন৷ কিন্তু কে শোনে কার কথা৷ 

সব মিলিয়ে ভারতে এখনো যে কিছু কিছু নদী টিকে আছে, পুরোপুরি যদি হয়ে যায়নি সেই এক আশ্চর্য৷ কতদিন এই নদীগুলি থাকবে, গবেষণাপত্রেই হয়তো তা কেবল ধরে রাখা সম্ভব৷