1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

দামের চাপে দম যায়

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
১০ মার্চ ২০২৩

বাংলাদেশে এক দিন আগের দামের হিসেব করে বাজারে গেলে পরের দিন পণ্য কম কিনতে হবে বা কোনো পণ্য কেনার তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে৷ কারণ প্রতিদিনই কোনো না কোনো পণ্যের দাম বাড়ছে৷ এখন দৌড়াচ্ছে ব্রয়লার মুরগির দামের পাগলা ঘোড়া৷

https://p.dw.com/p/4OUCM
বাংলাদেশের একটি বাজার পরিদর্শন করছেন কর্মকর্তারা৷
রমজানে যেন কেউ বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে না পারে, সরবরাহে যাতে সংকট তৈরি না হয় সেটা মনিটরিং-এ জোর দিচ্ছে ভোক্তা অধিদপ্তর৷ (ফাইল ছবি)ছবি: bdnews24.com

এক মাসে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজি বেড়েছে ১১০ টাকা৷ এব মাস আগে ১৬০ টাকা কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম এখন ২৭০ টাকা৷ আর শবেবরাতের আগের দিন গরুর মাংসও এক লাফে কেজিতে বেড়েছে ২০ টাকা৷ ১৩-১৪ দিন পর রোজা শুরু হবে৷ তাই এখনই যে দামের এই ঊর্ধ্বগতি থামবে তা বলা যায় না৷ রোজা শুরুর আগেই নিত্য পণ্যের দাম অনেক বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা৷ এটা একটা নতুন কৌশল৷ আগে রোজার সময় বাড়ত৷ এবার রোজা শুরুর এক মাস আগেই তারা বড়িয়ে দিয়েছেন৷ গরুর মাংস অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে কেজি ৮০০ টাকা ছুঁয়েছে৷

সরকার বিদ্যুতের দাম দুই মাসে তিন বার বাড়িয়েছে৷ গ্যাসের দাম বড়ানো হয়েছে৷ বাড়ানো হয়েছে জ্বালানি তেলের দাম৷ দাম বাড়ার এই চতুর্মুখী চাপে সাধারণ মানুষ এখন আর কুলিয়ে উঠতে পারছেন না৷ কোনোভাবেই আয়-ব্যয় মিলছে না৷ তাই মানুষ এখন কম কিনছেন, কম খাচ্ছেন৷

ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী নাজমুল হক তপন বলেন, ‘‘ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে এখন স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে আমরা যাত্রা শুরু করেছি৷ কিন্তু ব্যবসায়ীরা এরইমধ্যে পুরোপুরি স্মার্ট হয়ে গেছেন৷ তারা রোজার এক মাস আগেই নিত্য ভোগ্যপণ্যের দাম এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যে রোজার সময় আর বাড়াতে হবে না৷ দাম বাড়ানের পিকে চলে গেছেন তারা৷ ফলে রোজায় যদি দুই-একটি পণ্যের দাম কমেও যায় তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না৷ এটা তাদের কৌশল৷’’

তিনি জানান, ‘‘গত এক মাসে সব ধরনের পণ্যের দাম গড়ে ১০ থেকে ৩০ টাকা বেড়ে গেছে৷ এতদিন কম খেয়ে, কম কিনে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করেছি৷ কিন্তু এখন সেভাবেও পারছি না৷ তাই এমাসে বাসা পরিবর্তন করে কম ভাড়ায় ছোট বাসায় উঠেছি৷ পরিস্থিতি এভাবে চলতে থাকলে হয়তো গ্রামে চলে যেতে হবে৷ সেখানে তো আর বাসা ভাড়া লাগবে না৷ আসলে আমরা যারা অল্প আয়ের মানুষ তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছি৷’’

তিনি জানান, সবচেয়ে কম দামের মাছ তেলাপিয়ার কেজিও একমাসে ৫০ ভাগ বেড়ে ২৫০ টাকা কেজি হয়েছে৷

এই সময়ে সবচেয়ে আলোচিত ব্রয়লার মুরগির দাম হু হু করে বাড়া৷ রোজার আগে ব্রয়লার মুরগির বাজরে এই পরিস্থিতি কেন? এর জবাবে বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, ‘‘এর জন্য দায়ী কর্পোরেট সিন্ডিকেট৷ বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে কর্পোরেট ব্যবসায়ীরা৷ একটি প্রতিষ্ঠান আছে যারা ডিম, মুরগির বাজারের ২০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে এককভাবে৷ আমরা শত শত ছোটে খামারিরা তাদের কাছে অসহায়৷ দাম বাড়লেও তা আমরা পাই না৷ কারণ আমরা সরাসরি বাজারে দেই না৷ ব্যবসা লুটে নেয় কর্পোরেটরা৷’’

একটি প্রতিষ্ঠান আছে যারা ডিম, মুরগির বাজারের ২০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে এককভাবে: সুমন হাওলাদার

তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে প্রতিদিন ব্রয়লার মুরগির চাহিদা তিন হাজার ৫০০ টন৷ বাজারে যে কর্পোরেট কোম্পানির ২০ ভাগ শেয়ার আছে তারাই প্রতিদিন ছয় কোটি, মাসে ১৮০ কোটি টাকা বাড়তি মুনাফা লুটেছে৷ তারা ডিম মুরগির বাচ্চা সব কিছুতেই সিন্ডিকেট করে৷’’

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘‘দেশে উৎপাদিত এবং আমদানি করা সব ধরনের ভোগ্যপণ্যই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে৷ আমরা সেটা বার বার বলেছি৷ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা তাদের চিহ্নিতও করেছে; কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি৷ ভোজ্য তেলের সিন্ডিকেট, পেঁয়াজের সিন্ডিকেট, চালের সিন্ডিকেট সব কিছুই ওপেন৷ বিশ্ববাজারে ভোজ্য তেল আর জ্বালানি তেল দুইটির দামই কমেছে৷ কিন্তু এখানে কমেনি৷ সরকারের প্রতিষ্ঠান বিপিসি সাধারণ মানুষকে চাপে রেখে ব্যবসা করছে৷ আর সিন্ডিকেটগুলো সরকারের ছত্রছায়ায় সাধারণ মানুষের গলা কাটছে৷’’

তার কথা, ‘‘১০ টাকার সাবান ১৫ টাকা হয়েছে; কিন্তু কাঁচামালের দাম তো ৫০ ভাগ বাড়েনি৷ এই যে ব্রয়লার মুরগি, ডিমের দাম হু হু করে বাড়ল বাজারে তো কোনো সাপ্লাই সংকট হয়নি৷ তাহলে কেন এ বাড়তি দাম? সরকার কি এটা দেখেছে?’’

ভোজ্য তেলের সিন্ডিকেট, পেঁয়াজের সিন্ডিকেট, চালের সিন্ডিকেট সব কিছুই ওপেন: এস এম নাজের হোসেন

তিনি জানান, ‘‘কয়েক বছর ধরে ব্যবসায়ীরা একটা নতুন কৌশল নিয়েছে৷ রোজার এক-দেড়মাস আগেই ভোগ্যপণ্যের দাম সর্বোচ্চ বাড়িয়ে দেয় ৷ হয়ত রোজার সময় সরকারে অনুরোধে কিছুটা কমিয়েও দেবে৷এটা সরকারও জানে৷ সরকারের রেগুলেটরি বডিগুলো তাদের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয় না৷ সরকার জনবান্ধব নয়, ব্যবসাবান্ধব হয়েছে৷’’

অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, চার-পাঁচটি কারণে পণ্যের দাম বাড়তে পরে৷ ১. আমদানি করা পণ্যের দাম যদি আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ে ২. ডলারের অবমূল্যায়ন হলে যদি আমদানি পণ্যে তার প্রভাব পড়ে ৩ দেশের ভিতরে উৎপাদিত পণ্যের উৎপাদন খরচ যদি বাড়ে ৪. দেশের ভিতরে বাজারে যদি কোনো দুষ্কৃতি থাকে ৫. সরকার বাজার প্রভাবিত করতে যে কার্যক্রম নেয় যেমন, টিসিবির মাধ্যমে পণ্য দেয়া সেগুলো যদি ঠিকমত কাজ না করে৷

ভোজ্য তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ার পরও এখানে কমছে না কেন? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘এই একটি বিষয় দিয়ে পুরোটা ব্যাখ্যা করা যাবে না৷ বাজারের ভিতরে সমস্যা আছে৷ স্বচ্ছতার অভাব আছে৷ তথ্য উপাত্ত নিয়ে বাজারে নজরদারির সংকট আছে৷ সরকার তো আমদানি করা পণ্যের দাম জানে৷ তাহলে দাম বেশি নেয় কীভাবে? আসলে এই সময়ে সরকারের বাজারের ওপরে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রভাব খুবই দুর্বল৷’’

তিনি এখনকার বাজার ব্যবস্থাকে বিকৃত বাজার ব্যবস্থা হিসেবে অভিহিত করে বলেন, ‘‘এই বিবৃতি বাজার ব্যবস্থার কাছে ক্রেতারা এখন অসহায় অবস্থায় আছে৷’’

তবে ব্যবসায়ীদের কথা আলাদা৷ এখন তারা ডিমান্ড আর সাপ্লাইয়ের কথা বলছেন৷ এফবিসিসিআইর সাবেক পরিচালক মো. হেলাল উদ্দিন দাবি করেন, ‘‘মুরগি ও ডিমের দাম এখনই ঠিক আছে৷ আগে কম ছিল৷ চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদন হত৷ এখন উৎপাদন কমে দাম সঠিক পর্যায়ে এসেছে৷ আগে খামরিদের লোকসান হতো৷ আর রমজানের পণ্য ছোলা, চিনি, পেঁয়াজ, খেজুর, সয়াবিন তেলের আমদানি কম৷’’

মনিটরিং-এ এবার আমরা বাজার কমিটিকে অন্তর্ভুক্ত করছি: এ এইচ এম সফিকুজ্জামান

কিন্তু জানুয়ারি মাসে ব্যবসায়ীরা ডলার সংকটে এলসি না খুলতে পারার কথা বললেও বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ উদ্যোগ নেয়ায় সেই সংকট কেটে যায়৷ তারপরও অজুহাত শেষ হয় না৷ হেলাল উদ্দিন দাবি করেন, ‘‘দেশে ব্যবসায়ীদের কোনো সিন্ডিকেট নাই৷ থাকলে সরকার তাদের ধরুক৷ আমরা বাধা দেব না৷ বাজারের দাম বাজারই ঠিক করে, আমাদের সেখানে কিছু করার নাই৷’’

ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘‘আমরা শুধু ভোক্তা অধিদপ্তর তো এককভাবে বাজার ঠিক করতে পারব না৷ এখানে আরো অনেকের দায়িত্ব আছে৷ তবে রমজানে যাতে কেউ বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে না পারে, সরবরাহে যাতে কোনো সংকট তৈরি না হয় সেটা মনিটরিং-এ জোর দিচ্ছি৷ এই মনিটরিং-এ আমরা এবার বাজার কমিটিকে অন্তর্ভুক্ত করছি৷ যাতে তাদেরও দায়ের মধ্যে আনা যায়৷ কোনো বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ে অস্থিরতা দেখা দিলে তাদেরও দায় নিতে হবে৷’’

তিনি জানান, গত একমাস ধরে তারা বিভিন্ন ব্যবসায়ী গ্রুপের সঙ্গে বৈঠক করেছেন৷ তাতে বেশ কিছু সমস্যা পাওয়া গেছে৷ সেগুলো ঠিক করছেন৷ কেউ যাতে প্রতারণা করতে না পারে, বেশি দাম নিতে না পারে, মজুত করতে না পারে অভিযান শুরু হয়েছে৷ বিশেষ করে ব্রয়লার মুরগির বাজারে তারা অভিযানে জোর দিয়েছেন৷ আর ভোজ্য তেলের বাজার এখন স্বাভাবিক হয়ে এসেছে বলে দাবি করেন তিনি৷